বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের সংস্কার প্রক্রিয়া কতদূর?

0 1

গতবছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার দেশের অন্যান্য আরও অনেক খাতের মতো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেও সংস্কারের নানা উদ্যোগ নেয়। বিগত সরকারের সময় সম্পাদিত চুক্তি পর্যালোচনা করার জন্য গঠন করা হয় কমিটিও। দ্রুত সরবরাহ চুক্তি বা বিশেষ বিধান আইন বাতিলসহ আরও নানা উদ্যোগও নেওয়া হয়।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে করা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চুক্তি পর্যালোচনা করতে জাতীয় কমিটি গঠন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিশেষ আইনের অধীনে করা এসব চুক্তিতে সরকারের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো রক্ষিত হয়েছে কি না, কমিটিকে তা নিরীক্ষা করতে বলা হয়। পর্যালোচনা কমিটি আদানি, সামিট, বেক্সিমকো, ইন্ট্রাকোসহ ১১ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তথ্য পর্যালোচনা করেছে।

কমিটি সরকারকে আন্তর্জাতিক আইনি ও তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান নিয়োগের পরামর্শ দেয়। তবে সেই সুপারিশের ৫ মাস পেরিয়ে গেলেও সরকার এখনো তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আন্তর্জাতিক তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে সচিব ভালো বলতে পারবেন।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ফারজানা মমতাজের সাথে যোগাযোগ করা হলে তার সাড়া মেলেনি। তবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের যুগ্মসচিব (সদস্য-অর্থ) অঞ্জনা খান মজলিস ঢাকা পোস্টকে বলেন, পর্যালোচনা কমিটির কাজ চলছে।

পর্যালোচনা কমিটির সর্বশেষ অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড.আবদুল হাসিব চৌধুরীও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে সংস্কার কার্যক্রম ও আর্থিক চাপ কমাতে সরকারের জোরালো পদক্ষেপ দরকার। বিভিন্ন সময়ে নানা কার্যক্রম গৃহীত হলেও সেসবের গতিতে এখন অনেকটাই ভাটা পড়েছে।

অন্যান্য সংস্কারে কতটুকু অগ্রগতি?
দেশের বিদ্যুৎ খাতের ক্রয়চুক্তি পর্যালোচনা, ট্যারিফ পর্যালোচনাসহ বিদ্যুৎ খাতের সংস্কারে বেশ কয়েকটি কমিটি কাজ করছে। বিদ্যুৎ খাতের ব্যয় কমাতে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ট্যারিফ পর্যালোচনাতেও একটি কমিটি গঠন করে সরকার। তিন মাস পার হলেও এ কমিটি থেকে কোনো সুপারিশ পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান জানান, ট্যারিফ পর্যালোচনা কমিটির কাজ এখনও চলছে।

বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের সাথে ডলারে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির ফলে দীর্ঘদিন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিপিডিবি। টাকার অবমূল্যায়নে এ ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে।
চুক্তি সংশোধনে বিশেষজ্ঞরা স্থানীয় মুদ্রায় ক্রয়চুক্তি করার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু সে বিষয়েও সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়নি এখনও।

আওয়ামী সরকারের সময়ে বিনা দরপত্রে বিদ্যুৎ খাতে অযৌক্তিক ও ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়। এতে বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন দেশি-বিদেশি কোম্পানির পকেটে বিপুল পরিমাণ টাকা প্রবেশ করে। বিদ্যুতের অব্যাহত এ লোকসান কাটাতে বছরের পর বছর বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। আর বিদ্যুতের এ মূল্যবৃদ্ধি বাড়িয়ে তোলে জনগণের আর্থিক চাপ ও ভোগান্তি।

বিনা দরপত্রে কাজ পাওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ভারতের আদানি পাওয়ার। প্রতিষ্ঠানটিকে নানান অবৈধ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগে দেশের বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন চুক্তি বাতিল করতে সরকারকে আহ্বান জানায়। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো চুক্তি বাতিল করা হয়নি।

সার্বিক সংস্কার কার্যক্রমের বিষয়ে উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে। কিন্তু প্রক্রিয়াটি কিছুটা ধীরগতির। একদিনেই সব সমাধান সম্ভব নয় বা সব চুক্তি বাতিল করাও সম্ভব নয়। তবে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
দেশের বিদ্যুৎ খাতে অযৌক্তিক ব্যয় ও আর্থিক চাপ কমাতে প্রয়োজন সরকারের জোরালো উদ্যোগ। এর মাধ্যমে বিদ্যুতের ক্রয়চুক্তি বাতিল, কেন্দ্রগুলোর কাঠামোগত সংস্কার, সরকারের দিক থেকে বিদ্যুৎ খাতে সুযোগ-সুবিধাগুলো বাস্তবায়ন করার সুযোগ ছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেসবের তেমন কিছুই সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়নি।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রথমত বলতে চাই, বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে কোনো সংস্কার লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। যেসব রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো খুবই ভাসাভাসা, যাতে তেমন কোনো সমাধানও নেই এবং সরকারের একটা নিষ্ক্রিয়তাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

নিষ্ক্রিয়তার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সরকার ভাবছে আমরা তো বেশিদিন ক্ষমতায় থাকবো না। আর এ ভাবনা থেকেই জোরালো পদক্ষেপটা আসছে না। ফলে গতানুগতিকভাবেই সব চালানো হচ্ছে, যা হতাশাজনক।

Leave A Reply

Your email address will not be published.