বিশ্বব্যাপী পাসপোর্ট র্যাংকিংয়ে ভারতের অবস্থান আরও নিচে নেমেছে। হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্সে দেশটির অবস্থান এখন ৮৫তম। যা গত বছরের চেয়ে পাঁচ ধাপ নিচে।
অথচ রুয়ান্ডা, ঘানা ও আজারবাইজানের মতো ছোট অর্থনীতির দেশগুলোও ভারতের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। বিশ্ব র্যাংকিংয়ে ভারতীয় পাসপোর্টের অবনতি কেন? এই পতনের পেছনে কারণই বা কী?
শনিবার (১ নভেম্বর) এক প্রতিবেদনে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি সেই প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে।
আর তার এই অসন্তুষ্টি প্রতিফলিত হয়েছে হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স–এর সাম্প্রতিক তালিকায়ও। ওই তালিকায় বিশ্বের ১৯৯ দেশের মধ্যে ৮৫তম স্থানে রয়েছে ভারত। যা গত বছরের চেয়ে পাঁচ ধাপ নিচে।
এই সূচক অনুযায়ী, পাসপোর্টধারীরা কতগুলো দেশে ভিসামুক্তভাবে ভ্রমণ করতে পারেন, তার ওপর ভিত্তি করে র্যাংক নির্ধারণ করা হয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনো এই প্রতিবেদনের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। বিবিসি জানিয়েছে, তারা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে।
রুয়ান্ডা, ঘানা ও আজারবাইজানের মতো ছোট অর্থনীতির দেশগুলো এই র্যাংকিংয়ে ভারতকে পেছনে ফেলেছে। এই দেশগুলোর অবস্থান যথাক্রমে ৭৮তম, ৭৪তম ও ৭২তম স্থানে। অথচ ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ।

গত এক দশক ধরেই ভারতীয় পাসপোর্টের অবস্থান ৮০-এর ঘরেই ঘোরাফেরা করছে, এমনকি ২০২১ সালে তা নেমে গিয়েছিল ৯০তম স্থানে। সেই তুলনায় জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো এশীয় দেশগুলো নিয়মিতভাবে র্যাংকিংয়ে শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে।
এই বছরও আগের মতোই সূচকের শীর্ষে রয়েছে সিঙ্গাপুর। দেশটির নাগরিকরা ১৯৩টি দেশে ভিসামুক্তভাবে ভ্রমণ করতে পারেন। দ্বিতীয় স্থানে দক্ষিণ কোরিয়া (১৯০ দেশ), তৃতীয় স্থানে জাপান (১৮৯ দেশ)।
অন্যদিকে, ভারতীয় পাসপোর্টধারীরা ৫৭টি দেশে ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার পান। আফ্রিকার দেশ মৌরিতানিয়ার নাগরিকরাও একই সংখ্যক দেশে প্রবেশাধিকার পান, ফলে দুই দেশের অবস্থানই ৮৫তম।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পাসপোর্টের শক্তিমত্তা একটি দেশের ‘সফট পাওয়ার’ ও বৈশ্বিক প্রভাবের প্রতিফলন। শক্তিশালী পাসপোর্ট মানে নাগরিকদের জন্য বেশি ভ্রমণ সুযোগ, ব্যবসা ও শিক্ষা সম্প্রসারণের সুবিধা। বিপরীতে দুর্বল পাসপোর্ট মানে বেশি কাগজপত্র, উচ্চ ভিসা ফি, কম সুবিধা ও দীর্ঘ অপেক্ষা।
তবে র্যাংক কমলেও ভারতীয়দের জন্য ভিসামুক্ত গন্তব্যের সংখ্যা গত এক দশকে বেড়েছে।
উদাহরণ হিসেবে ২০১৪ সালে — যখন নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসে — ভারতীয়রা ৫২টি দেশে ভিসামুক্ত ভ্রমণ করতে পারতেন, আর দেশটির অবস্থান ছিল ৭৬তম। এক বছর পর তা নেমে আসে ৮৫তম স্থানে। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে কিছুটা উন্নতি হয়ে ৮০তম স্থানে উঠলেও এবার আবার ৮৫তম স্থানে নেমে গেছে। এ সময়ের মধ্যে ভিসামুক্ত গন্তব্য বেড়েছে ৫২ দেশ থেকে ৬২টিতে, যদিও ২০২৫ সালে তা আবার কমে ৫৭ হয়েছে।
র্যাংকিংয়ে ভারতীয় পাসপোর্টের অবনতি কেন?
বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক ভ্রমণ প্রতিযোগিতা এখন অনেক বেড়েছে। বিভিন্ন দেশ তাদের নাগরিকদের জন্য নতুন ভ্রমণ চুক্তি করছে, যার ফলে র্যাংকিংয়ে তাদের উন্নতি হচ্ছে।
হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালে বিশ্বব্যাপী গড়ে একজন ভ্রমণকারী ৫৮টি দেশে ভিসামুক্তভাবে যেতে পারতেন, ২০২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৯টিতে।
চীনের উদাহরণও দেওয়া হয়েছে। গত এক দশকে দেশটি ভিসামুক্ত গন্তব্যের সংখ্যা ৫০ থেকে বাড়িয়ে ৮২ করেছে। ফলে তাদের অবস্থান ৯৪তম থেকে উন্নীত হয়ে এখন ৬০তম।

অন্যদিকে, ভারত এ বছরের জুলাইয়ে ৫৯টি দেশে প্রবেশাধিকার পেয়ে ৭৭তম স্থানে ছিল। কিন্তু অক্টোবর নাগাদ দুটি দেশের প্রবেশাধিকার হারিয়ে তা নেমে যায় ৮৫তম স্থানে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত আচল মালহোত্রা বলেন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বিদেশিদের প্রতি একটি দেশের উন্মুক্ত মনোভাবও পাসপোর্টের শক্তিমত্তা নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।
তিনি উদাহরণ দেন— যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট একসময় শীর্ষ ১০–এ থাকলেও এখন ১২তম স্থানে নেমে এসেছে, যা ঐতিহাসিকভাবে সর্বনিম্ন। বৈশ্বিক রাজনীতিতে ভারতের ক্রমবর্ধমান একঘরে নীতিই এর প্রধান কারণ।
মালহোত্রা আরও বলেন, ১৯৭০–এর দশকে ভারতীয়রা অনেক পশ্চিমা ও ইউরোপীয় দেশে ভিসামুক্তভাবে ভ্রমণ করতে পারতেন। কিন্তু ১৯৮০–এর দশকে খালিস্তান আন্দোলনের সময় অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা বাড়ায় তা বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী রাজনৈতিক টানাপোড়েনও ভারতের স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
তিনি বলেন, “অনেক দেশ এখন অভিবাসন নিয়ে বেশি সতর্ক। ভারত থেকে অনেক মানুষ বিদেশে গিয়ে স্থায়ী হয় বা ভিসার মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার পরও অবস্থান করে, যা দেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।”
তিনি আরও বলেন, একটি দেশের পাসপোর্টের নিরাপত্তা ও অভিবাসন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতাও ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এছাড়া ভারতের পাসপোর্ট এখনো নিরাপত্তা হুমকির মুখে রয়েছে। ২০২৪ সালে দিল্লি পুলিশ ভিসা ও পাসপোর্ট জালিয়াতির অভিযোগে ২০৩ জনকে গ্রেপ্তার করে। এছাড়া দেশটিতে অভিবাসন প্রক্রিয়া জটিল ও ধীরগতির বলেও পরিচিত।
মালহোত্রা মনে করেন, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন যেমন সম্প্রতি চালু হওয়া ভারতের ই-পাসপোর্ট— এগুলো নিরাপত্তা বাড়াতে ও প্রক্রিয়া সহজ করতে সাহায্য করবে। এই ই-পাসপোর্টে একটি ছোট চিপে বায়োমেট্রিক তথ্য সংরক্ষিত থাকে। আর এর ফলে অপরাধীদের জন্য নথি জাল করা কঠিন হয়ে যায়।
তবুও বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতীয় নাগরিকদের বৈশ্বিক চলাচল সহজ করতে এবং দেশের পাসপোর্টের অবস্থান উন্নত করতে কূটনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি ও নতুন ভ্রমণ চুক্তিই এখন সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
