ডিজিটাল আর্কাইভ ও গনহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করতে হবে

0 3,369

ইমরান হোসাইন আদ্রিয়ান: মার্চের ২৪ তারিখে জাতিসংঘ মহাসচিবের গণহত্যা প্রতিরোধ বিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা আদামা দিয়েং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করে জানিয়েছেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা বিষয়ে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোর সঙ্গে কাজ করবে। তিনি ইঙ্গিত করেন কিছু কিছু দেশ এতে বিরোধিতা করতে পারে, তারপরও জাতিসংঘ এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।

আদামা দিয়েং সেনেগালের নাগরিক ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আইনসঙ্গত উপায়ে বিশ্ব জনমত সংগঠনে তার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। সেনেগাল সুপ্রীমকোর্টের প্রাক্তন এই রেজিস্ট্রারকে ২০০১ সালে কফি আনান রুয়ান্ডা আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দেন। সেই থেকে তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট নানা উদ্যোগ ও কাজের সঙ্গে গভীরভাবে নিজেকে সক্রিয় করে যথেষ্ট সম্মান অর্জন করেছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আদামা দিয়েংকে ২০১২ সালের ১৭ জুলাই মহাসচিব বান কি-মুন গণহত্যা বিষয়ে বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন।

এরকম একজন প্রভাবশালী মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব যিনি সরাসরি জাতিসংঘ মহাসচিবের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। তিনি যখন ঢাকায় এসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেন যে, জাতিসংঘ বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের গণহত্যা বিষয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোর সঙ্গে কাজ করবে, এতে আমাদের সিরিয়াস ও মনোযোগী হবার সুযোগ আরও বাড়ল। আমার জানা মতে, আদামা দিয়েং তার প্রায় সকল কাজেই একজন সফল সংগঠক ও নানারকম প্রতিবন্ধকতা ও সমালোচনার মধ্যেও নিজ কাজে অটল থেকে বিশ্ব মানবতা সুরক্ষায় প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন।

এখন আমাদের মনযোগ দিয়ে ভাবতে হবে কেমন করে জাতিসংঘের সঙ্গে থেকে এই সুযোগের সুপ্রযুক্ত ব্যবহার করে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সংঘটিত পৈশাচিক গণহত্যার বিশ্ব স্বীকৃতি আদায় করে নেয়া যায়। বাংলাদেশের আইনসভা ইতোমধ্যে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরের ঊষালগ্নে এই দিবসের তাৎপর্য, পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহ ও তথ্য উপাত্ত নিয়ে এখন আমাদের বিশ্ব দরবারের উপস্থাপন করতে হবে যাতে ৫০ বছর আগে দক্ষিণ এশিয়ার এই ভূ-খণ্ডে কিছু পরাশক্তির প্রভাবে ও সহযোগিতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা কী নির্মম হত্যাকা- ঘটিয়েছিল, সেসবের সচিত্র বিবরণ ও তথ্য-উপাত্ত দেখে বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হয় ও দংশনবোধ করে এই ভেবে যে- সেই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের মূল নায়কদের আন্তর্জাতিক দরবারে আজও কোন বিচার হয়নি। এমনকি সেদিন বিশ্ব বিবেক লুণ্ঠনের মদদে যারা সম্পর্কিত তাদেরও চিহ্নিত করে ইতিহাসের গতি ন্যায়সঙ্গত পথে চলতে দিতে দুনিয়ার সবাইকে সমস্বরে কথা বলতে দিতে হবে। এর দায় শুধু বাংলাদেশের একার নয়।

আমরা জানি, বাংলাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও গবেষকগণ দীর্ঘদিন যাবত নানারকম প্রচেষ্টায় গণহত্যা নিয়ে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন, যার ফলে বিভিন্ন প্রকাশনা ও উপাত্ত এখন আমাদের করায়ত্ত হয়েছে। হয়তো আরও তথ্য উদ্ঘাটিত হবে কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি পূর্বসূরিদের ইতিহাস চর্চার প্রভাবে ও বর্তমান সরকারের নানামুখী উদ্যোগের ফলে দেশে এখন নতুন প্রজন্মের এই বিষয়ে নতুন নতুন গবেষণার অনুপ্রেরণা তৈরি হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন সংঘটিত হত্যাকান্ডের ঘটনাপ্রবাহ চিহ্নিত হচ্ছে ও হত্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো সম্পর্কে জানা যাচ্ছে। ডিজিটাল যুগে এসব তথ্য-উপাত্তগুলো তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া এখন খুবই সহজ ও বাস্তবসম্মত।

আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ও অনুপ্রেরণায় এখন যে কাজটি পরিচালিত হচ্ছে তা হলো ‘তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ’ বা হাতের নাগালে ১৯৭১ সালের ‘এভিডেন্স’গুলো নিয়ে আসা। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই বাংলাদেশের ভূ-ভাগের বঞ্চনা ও আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের পটভূমি, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও ভূমিকা এখন স্পষ্টতই পাওয়া যাচ্ছে সম্প্রতি প্রকাশিত ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস’ সিরিজগুলোতে। ইতোমধ্যে প্রকাশিত এই সিরিজের প্রথম দুই খন্ডে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অপার বিস্ময় উন্মোচিত হয়েছে, বাকি ১২ খ-তে আমরা পেতে যাচ্ছি আরও বিস্ময় কারণ আমরা ইতিহাসের অপর এক দিক ‘মিথ্যাচার’ জগতে বসবাস করে জানতে পারিনি ‘সত্য’ আসলে কি? এসব ‘এভিডেন্স’ আমাদের এখন নির্দেশনা দেবে হয়তো মহাকাল পুরো ইতিহাসই আমাদের কাছ থেকে জেনে তা নতুন করে লিখিয়ে নেবে।

সে ইতিহাস রচনায় অংশ নিতে হবে আমাদের সবাইকে। ১৯৭১ সালের প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে দেশে জীবিত মানুষের সংখ্যা এখন মোট জনসংখ্যার ১৫% ভাগের মধ্যে। স্মৃতিশক্তি অক্ষুণœ আছে এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আরও কম হবে। ফলে আমাদের এখনি পরিকল্পনা করে কাজ ভাগ করে নিতে হবে অন্তত বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামের একটি করে ৭১ সালের ঘটনার সরেজমিন বিবরণ ভিডিও চিত্রে সংগ্রহ করে নেয়া। ৮০ হাজার গ্রামের একটি ঘটনার ১০ মিনিট ভিডিওচিত্র ধারণ করে একটি নির্ধারিত সার্ভারে সংরক্ষণ করতে পারলেও সেসব ভিডিও চিত্রের মোট পরিমাণ দাঁড়াবে ৮ লক্ষ মিনিট (১৩ হাজার ঘণ্টার কিছু বেশি)। যে বিষয়গুলো আমাদের এই প্রযুক্তি সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তি হবে সেগুলো মোটা দাগে হতে পারে-

১. ২৫ মার্চ বা প্রথম দিনের ঘটনা, ২. নয় মাসব্যাপী পাকিস্তানী বাহিনীর সরাসরি হত্যাকান্ডের তথ্য, ৩. রাজাকার-আল বদর ও আল শামসদের মাধ্যমে সংঘটিত হত্যাকান্ডের তথ্য, ৪. নারী নির্যাতনের তথ্য, ৫. মুক্তিসংগ্রামে সমর্থক পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকান্ডের বিবরণ ও ৬. বধ্যভূমি চিহ্নিতকরণ।

কিছুদিন আগে টেলিভিশনের এক সাক্ষাতকারে দেখলাম আরিফ রহমান নামের একজন সক্রিয় তরুণ গবেষক জানাচ্ছেন এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত বধ্যভূমিগুলো লোকেশন কেমন করে গুগোল ম্যাপে সন্নিবেশ করে নেয়া যায় তিনি সে নিয়ে কাজ করছেন। আমি খুবই উৎসাহ বোধ করেছি এই তথ্যটি জেনে যে, নতুন প্রজন্ম নিশ্চয়ই উদ্ভাবনী উপায়ে তথ্য-প্রযুক্তির সপ্রযুক্ত ব্যবহার করে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের জানা-অজানা ঘটনাগুলো স্মার্ট ইতিহাসের স্বাক্ষ্য হিসেবে দালিলিক করতে সমর্থ হবেন। আরিফ রহমান তার রচিত গবেষণা-পত্র ‘তিরিশ লক্ষ শহীদ, বাহুল্য নাকি বাস্তবতা’ বইয়ে সেকেন্ডারি সোর্সের তথ্য-উপাত্ত নিয়েই প্রমাণ করেছেন বাংলাদেশের গণহত্যার সংখ্যার বাস্তবতা যা পড়তে গেলে শরীর শিউরে ওঠে।

ফলে আমাদের উচিত হবে প্রাপ্ত সব তথ্য মিলিয়ে নিয়ে বিশ্ব দরবারে হাজির হওয়া। আদামা দিয়েং তাঁর নিজস্ব তথ্য ভা-ারে বাংলাদেশের গণহত্যার তথ্য-প্রমাণ কেমন করে পাবেন ও সংরক্ষণ করবেন আমাদের সে চেষ্টায় নিয়োজিত হতে হবে। আমার জানা মতে, বাংলাদেশের মিশন ও দূতাবাসগুলো এই বিষয়ে যেসব কাজ করে সেসব খুবই গতানুগতিক ও দায়সারা, তা-ও যদি ঢাকা থেকে নির্দেশনা যায় তবে।

জাতীয় দিবসগুলোতে তারা যেসব অনুষ্ঠান করে সেগুলোতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাশাপাশি সেসব দেশের সব ধরনের নাগরিকদের আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। সব দূতাবাসে থাকা উচিত একটি মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রহশালা (ছবি-সিনেমা বা দলিলাদি রিপ্রোডাকশন করেই প্রদর্শনের জন্যে রাখা যায়)। সব দেশের বড় শহরগুলোতে একটি করে মুক্তাঙ্গন আছে যেখানে যে কেউ চাইলে বিনামূল্যেই একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করতে পারে। আমাদের গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধের ছবি দিয়ে এরকম উন্মুক্ত প্রদর্শনী দূতাবাসগুলো করতে পারে। বুঝতে হবে বিশ্ব জনমত সংগঠিত করতে হলে আমাদের স্মার্ট প্ল্যানে যেতে হবে। আমাদের এও বুঝতে হবে বিদেশের বর্তমান প্রজন্ম বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের ঘটনা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। ব্রিটেনের রাজনীতিতে ও নেতৃত্বে এখন যারা ভূমিকা রাখছেন তাদের শতকরা ৫৬ভাগ জন্মেছেন ১৯৭১ সালের পরে। এরকম সব দেশে যদি আমরা সে দেশের নেতৃত্ব ও তরুণ শিক্ষাবিদদের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার তথ্য সে সব দেশে বিতরণ করতে না পারি- তাহলে, কোনভাবেই বিশ্বসমাজ আমাদের কথায় কান দেবে না।

এখন পর্যন্ত আমাদের সংগ্রহে যা আছে সব সরকারী নিয়মের মধ্যে এনে ক্লাউড সার্ভারে সংরক্ষণ ও উন্মুক্ত করা দরকার যেন যে কেউ যে কোন স্থানে যখনই দরকার হবে সেসব তথ্য ব্যবহার করে যুক্তি তর্কে অংশ নিতে পারে। আলোকচিত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্বাপর দৃশ্যগুলো নিয়ে জাতিসংঘের বারান্দায় প্রদর্শনীর আয়োজন করা বা সেমিনার-সিম্পোজিয়াম পরিচালনা করা মোটেই কঠিন নয়। আমাদের মিশনগুলো সেরকম উদ্যোগ কেন নিতে চায়না বা নেয় না জানি না। তবে আমার ধারণা, ঢাকার উপর প্রশাসনিক নির্ভরশীলতাই এরকম কাজে কোন আগ্রহ আমাদের দূতাবাসের অফিসারদের মধ্যে তৈরি হয় না।

তাই, ১৯৭১ সালের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে একটি সর্বমহলের অংশগ্রহণমূলক পরিচালনা নীতি নেয়া জরুরী। দেশের মধ্যে এই নিয়ে দাবি উচ্চারণে সীমিত না থেকে আমাদের উচিত হবে বিদেশের সব দূতাবাসকে সক্রিয় করে প্রবাসী বাংলাদেশী, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও প্রবাসে বসবাসরত মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সম্পৃক্ত করে প্রত্যেকের নিজেদের যার যার অবস্থানে ভূমিকা পালন করা। কিন্তু এজন্যে একটি আহ্বান যেতে হবে দেশ থেকে যেন সকলেই উদ্বুদ্ধ হয় ও অভিমান ভুলে এই কাজে সম্পৃক্ত হয়। ১৯১৫ সালে অটোমান শাসনামলে আর্মেনিয়ার ১৫ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। আর্মেনিয়া প্রতি বছর ২৪ এপ্রিল সে নৃশংসতার স্মরণে গণহত্যা দিবস পালন করে থাকে ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্যে দাবি করে আসছে। ২০১৫ সালে পোপ ফ্রান্সিস ভ্যাটিকানে এক প্রার্থনা সভায় বলেছিলেন, ‘গত শতাব্দীতে মানব সভ্যতা তিনটি বড় ধরনের ট্র্যাজেডির ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। আর প্রথমটি ঘটেছে এই আর্মেনীয় জনগোষ্ঠীর ওপর, যা বিংশ শতাব্দীর প্রথম গণহত্যা।’ পোপ আরও মন্তব্য করেছেন ‘এটাকে ঢেকে রাখা বা অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ না বেধে সেখানে থেকে অনবরত রক্ত ঝরতে দেয়া।’

বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে এরকম স্বীকৃতি একদিন আসতে বাধ্য। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ যেন ঠিক সময়ে সে কাজটি করতে পারেন তার যথাযথ উপস্থাপন এখন আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। আর্মেনিয়া হত্যাকাণ্ডের ৩০ বছর পরে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ সম্মেলনে গণহত্যাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে তা নিবারণ ও শাস্তির আইন গৃহীত হয়। বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে জাতিসংঘকে কাজে লাগাবার ও বিশ্ব সমাজের আদালতে অপরাধীদের শাস্তি দেবার সেই সুযোগ তো তখন থেকে হয়েই আছে। এখন শুধু আমাদের কাজগুলো এগিয়ে নেয়া।

Leave A Reply

Your email address will not be published.