গুলশানে ‘ব্লিস আর্ট লাউঞ্জ’ নামের একটি বারের বাউন্সার ও কর্মচারীদের মারধরে দবিরুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ী নিহতের মামলায় দুই আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এজাহারনামীয় আসামি বারের নিরাপত্তাকর্মী প্লাবন মিয়া এবং বারের বাউন্সার রাকিব ঢাকার পৃথক দুটি মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
গত রোববার (২ নভেম্বর) আদালতে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন অভিযুক্ত এ দুই আসামি।
একাধিক সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, বারের ব্যবস্থাপক শামীমের সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে কথা বলছিলেন দবিরুল। একপর্যায়ে দবিরুল শামীমকে একটি থাপ্পড় দেন। পরে তার সঙ্গে থাকা কয়েকজন মিলে দবিরুলকে মারধর করেন। দবিরুল নিচে পড়ে গেলে একজন তার মাথায় লাথি দেন। এর কিছুক্ষণ পর কয়েকজন মিলে দবিরুলকে সেখান থেকে বারের নিচে রাস্তায় ফেলে আসেন।

এ প্রসঙ্গে গুলশান থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান বলেন, বারের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা দবিরুল ইসলামকে মারধর করেন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে আমরা কাজ করছি। গত এক সপ্তাহে সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আদালত তাদের তিনদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
সিকিউরিটি ইনচার্জের ঘুষি কাল হয়ে দাঁড়ায় ব্যবসায়ী দবিরুলের
জবানবন্দিতে আসামি বাউন্সার রাকিব বলেছেন, ‘গত ১৫ অক্টোবর (১৪ অক্টোবর দিবাগত রাত) রাতে তিনি বারের ভেতরে ডিউটিতে ছিলেন। রাত আনুমানিক সোয়া ১২টার দিকে বারের মধ্যে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে ডিউটিতে থাকা কয়েকজন এগিয়ে গিয়ে দেখেন— তাদের পূর্ব পরিচিত কাস্টমার তোফাজ্জল হোসেন তপু আরেক কাস্টমার দবিরুলকে মারছিলেন। পাশেই বারটির ম্যানেজার শামীম আহম্মেদ ওরফে সুমন উপস্থিত ছিলেন। শামীমের নির্দেশে তারা দবিরুলকে ধরে বারের নিচের গেটের বাইরে নামিয়ে দেন এবং উপরে চলে আসেন।’
‘পরে তিনি জানতে পারেন, তাদের সিকিউরিটি ইনচার্জ জামিল ও নিচে ডিউটিতে থাকা নিরাপত্তাকর্মী তামিমের সঙ্গে দবিরুলের মারামারির ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনায় গুলশান থানায় মামলা হয়। তার কিছুদিন পর তিনি মারা যান। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, জামিল লোকটিকে ঘুষি মারেন এবং জোরে ধাক্কা দিলে রাস্তার ওপর চিৎ হয়ে পড়ে যান। তখন জামিল ও নিচে ডিউটিতে থাকা তামিম তাকে বেশ কয়েকটা লাথি মারেন। আরেক নিরাপত্তাকর্মী প্লাবন লোকটির ডান পা, জামিল লোকটির বাম পা এবং রাজু ডান হাত ও কাউসার বাম হাত ধরে চেংদোলা করে বারের গেটের সামনে নাফি টাওয়ারের পেছনে রাস্তার ওপরে ফেলে আসেন।’

অপরদিকে আসামি প্লাবন জবানবন্দিতে বলেন, ‘গত ১৪ অক্টোবর দিবাগত রাতে তিনি বারের নিচে রাস্তার ওপর পার্কিং এলাকায় রাখা গাড়িগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছিলেন। রাত অনুমানিক সাড়ে ১২টার সময় বারের ভেতরে বিল নিয়ে ঝামেলায় তপু নামের এক কাস্টমারের সঙ্গে মারামারির ঘটনা ঘটায় বারের ম্যানেজার শামীমের নির্দেশে বারের মধ্যে কর্মরত থাকা বাউন্সার রাকিব, রুবেল ও লিটনরা দবিরুলকে নিচে নিয়ে আসে। পরে গেটের বাইরে রেখে তারা আবার ওপরে বারের ভেতরে চলে যান।’
‘পরবর্তী সময়ে দবিরুল বারবার বারের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন। ওই সময় সিকিউরিটি ইনচার্জ জামিল তাকে পুনরায় বারে ঢুকতে বাধা দিলে দবিরুলের সঙ্গে তার হাতাহাতি শুরু হয়। একপর্যায়ে জামিল স্যার লোকটিকে ঘুষি মারেন এবং জোরে ধাক্কা মারেন। ধাক্কা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকটি রাস্তার ওপর চিৎ হয়ে পড়ে যান। তখন জামিল স্যার ও নিচে ডিউটিতে থাকা তামিম তাকে বেশ কয়েকটা লাথি মারেন। লোকটি অজ্ঞান হয়ে গেছে বুঝতে পেরে প্লাবন লোকটির ডান পা, জামিল বাম পা এবং রাজু ডান হাত ও কাউসার বাম হাত ধরে চেংদোলা করে বারের গেটের সামনে নাফি টাওয়ারের পেছনে রাস্তার ওপরে নিয়ে যান। পরে তারা তার চোখে-মুখে ও মাথায় পানি দেন। ঘণ্টা দুয়েক পর দবিরুলের ছেলে এসে তাকে নিয়ে যান। পরে জানতে পারেন, ওই ঘটনায় গুলশান থানায় মামলা হয়েছে। তার কিছুদিন পর লোকটি মারা যান।’
সাতদিন পর হত্যাচেষ্টা মামলা, ১০ দিনের মাথায় হত্যার ধারা সংযোজন
দবিরুলের মৃত্যুর ঘটনায় গত ২০ অক্টোবর দিবাগত রাত ১২টা ৫ মিনিটে গুলশান থানায় তার স্ত্রী নাসরিন আক্তার বাদী হয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। বারের মালিকসহ ছয় কর্মচারীকে এজাহারনামীয় এবং অজ্ঞাতনামা ১০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
আসামিরা হলেন- বারের সিকিউরিটি ইনচার্জ মো. জামিল হোসেন, মালিক সাখাওয়াত হোসেন মোল্লা ওরফে রনি, ম্যানেজার মো. শামীম আহমেদ ওরফে সুমন, কর্মচারী রাজু আহমেদ, প্লাবন মিয়া ও মো. তামিম মোল্লা।
মামলার বিবরণী থেকে জানা যায়, ৫১ বছর বয়সী দবিরুল ইসলাম জমি কেনা-বেচার ব্যবসা করেন। ব্যবসার কারণে তিনি বিভিন্ন অফিস, রেস্টুরেন্ট বা বারে যাতায়াত করে থাকেন। গত ১৪ অক্টোবর দিবাগত রাত আনুমানিক ১১টার দিকে তিনি ব্যবসার কাজে ও খাবার খাওয়ার জন্য গুলশানের ‘ব্লিস আর্ট লাউঞ্জ লিমিটেড রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বার’-এ যান।
অভিযোগপত্রে স্ত্রী উল্লেখ করেন, সেদিন রাত ১২টা থেকে তাদের ছোট ছেলে দবিরুলের ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে রাত ২টার সময় ছোট ছেলে পুনরায় কল দিলে তিনি ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন যে, ব্লিস আর্ট লাউঞ্জ বারের নিচে নাফি টাওয়ারের পেছনে রাস্তায় ওপর পড়ে আছেন এবং দ্রুত তাকে এসে বাঁচাতে বলেন। এই কথা শোনার পর তার দুই ছেলে তায়েব ইসলাম (১৮) ও নাবিদ ইসলাম (২০) সিএনজি নিয়ে এসে দেখতে পান— দবিরুল রাস্তার ওপর অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছেন।

‘ছেলেরা প্রথমে তাকে মধ্যবাড্ডা আদর্শনগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। ওই রাতেই অ্যাম্বুলেন্সযোগে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসক তার মাথার সিটিস্ক্যান করে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে বলে জানান। পরে তাকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচার করে তার মাথার খুলি খুলে রেখেছেন।’
দবিরুল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অচেতন অবস্থায় চিকিৎসাধীন থাকাকালীন তার স্ত্রী নাসরিন মামলা দায়ের করেন। পরে ২৩ অক্টোবর বিকেল ৩টা ১৫ মিনিটে দবিরুল মারা যান।
অভিযোগে নাসরিন আরও উল্লেখ করেন, তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন— ১৪ অক্টোবর দিবাগত রাত অর্থাৎ ১৫ অক্টোবর রাত ১২টা ৫ মিনিট থেকে ২টার মধ্যে যেকোনো সময় বারে খাবারের বিল দেওয়া নিয়ে ওয়েটার ও ম্যানেজারের সঙ্গে তার স্বামী দবিরুলের বাকবিতণ্ডা হয়। পরে বারের মালিক শাখাওয়াত হোসেন মোল্লা রনির নির্দেশে বারের বাউন্সার, সিকিউরিটি গার্ড ও ম্যানেজার মিলে তাকে ধরে নিচে নিয়ে আসে।
‘মালিকদের নির্দেশে বারের বাউন্সার, সিকিউরিটি গার্ড ও ম্যানেজার মিলে রাত আনুমানিক ১২টা ২০ মিনিট থেকে ৪০ মিনিটের মধ্যে যেকোনো সময় হত্যার উদ্দেশ্যে দবিরুলের মাথায় আঘাত করলে তিনি মারাত্মক আঘাত পেয়ে রাস্তার ওপর পড়ে যান। আসামিরা তার চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে এবং দায় এড়ানোর জন্য গুলশান-১ এর নাফি টাওয়ারের পেছনে রাস্তার ওপর রেখে দেন।’
আসামিদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহসহ পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এজাহার দায়ের করতে দেরি হয় বলেও জানান বাদী নাসরিন আক্তার।
সাতজন গ্রেপ্তার, লাপাত্তা এক নম্বর আসামি
ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও এজাহারে মূল অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও সিকিউরিটি ইনচার্জ জামিল হোসেনকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। যদিও পুলিশ বলছে, অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা যায়, মামলা দায়েরের পর এজাহারনামীয় তিনজন ও সন্দিগ্ধ চারজনসহ মোট সাতজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
গত ২০ অক্টোবর দিবাগত রাতে মামলা দায়েরের পরদিনই আসামি বারের ম্যানেজার শামীম আহমেদ সুমন ও বাউন্সার রাজু আহমেদকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করে পুলিশ। পরে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তাদের কারাগারে আটক রাখার আবেদন জানালে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তা মঞ্জুর করেন।

দবিরুলের মৃত্যুর পরদিন ২৪ অক্টোবর তোফাজ্জল হোসেন তপু, বারের কর্মী রাকিব, কাউসার ও রুবেল মাহমুদকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওইদিনই তাদের আদালতে হাজির করে কারাগারে আটক রাখার আবেদন জানানো হলে তা মঞ্জুর হয়। একইদিন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান থানার পুলিশ পরিদর্শক এ. বি. সিদ্দিক ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের কাছে মামলার ধারার সঙ্গে হত্যার অর্থাৎ ৩০২ ধারা সংযোজনের আবেদন করলে আদালত তা-ও মঞ্জুর করেন। এরপর ২৮ অক্টোবর পুলিশ তাদের ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে তিনদিন করে মঞ্জুর করেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।
সর্বশেষ গত ৩০ অক্টোবর আসামি প্লাবনকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে গুলশান থানার কাছে হস্তান্তর করলে তাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আনা হয়। এ সময় তার সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। তদন্ত কর্মকর্তা সিদ্দিক তার এ রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। পরে তারও তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক এ. বি. সিদ্দিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘জামিল হোসেনকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে। গ্রেপ্তার আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পর্যালোচনা করে যদি অন্য কোনো আসামি জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যায়, তাহলে তাদেরকেও গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করা হবে।’
বারের অপর কাস্টমার তোফাজ্জল হোসেন তপুর সঙ্গে দবিরুলের পূর্ব কোনো সম্পর্ক ছিল কি না— এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমন কিছু আমরা এখনো উদ্ধার করতে পারিনি। মামলাটি তদন্তাধীন, তদন্ত চলছে।’
বাউন্সার কারা?
বাউন্সার হলেন বার বা নাইট ক্লাবগুলোতে দায়িত্ব পালনকারী বিশেষ ধরনের নিরাপত্তাকর্মী। তারা সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বারের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি দেখভাল করেন এবং গ্রাহকদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে সেটি নিয়ন্ত্রণ করেন। একটি বারে সাধারণত ৭-৮ জন থেকে শুরু করে ১৫-২০ জন বাউন্সার থাকেন।
