বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে পড়েছেন। নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা, সংস্কার কার্যক্রমে ধীরগতি, অর্থনৈতিক মন্দা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি–সব মিলিয়ে জনঅসন্তোষ বাড়ছে। সেনাবাহিনী, বিএনপি ও ব্যবসায়ীদের আগাম নির্বাচনের দাবি ইউনূসের অবস্থানকে আরও জটিল করে তুলছে। এই উত্তপ্ত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সহিংসতার আশঙ্কা বাড়ছে।
যদিও সমঝোতার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ রূপান্তরের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।মার্কিন সাময়িকী ফরেইন পলিসিতে এক মন্তব্য প্রতিবেদনে এমনটি জানিয়েছেন মাইকেল কুগলম্যান। তিনি ফরেইন পলিসির সাপ্তাহিক সাউথ এশিয়া ব্রিফে লেখেন এবং প্রায় দুই দশক ধরে এই অঞ্চল নিয়ে বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করছেন।প্রতিবেদনটিতে কুগলম্যান বলেন, গত বছরের আগস্টে ব্যাপক গণআন্দোলনের চাপে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার পর থেকে প্রায় ১০ মাস ধরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ ইউনূস।শুরুর দিন থেকেই ইউনূসের কাজ ছিল কঠিন। দীর্ঘদিনের সরকারি দমন-পীড়নের পর বাংলাদেশে পুনর্গঠন এবং গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রত্যাশায় উদগ্রীব জনগণের উচ্চ আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তাঁকে কাজ শুরু করতে হয়। তিনি এই সময়ে নিজের অবস্থান দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছেন। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে তাঁর জন্য ব্যাপক শ্রদ্ধা রয়েছে।কিন্তু এখন চাপ বাড়ছে, এবং পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে উল্লেখ করে কুগলম্যান লিখেছেন, ইউনূসের নেতৃত্বাধীন একটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বাংলাদেশি জনগণ ক্রমাগত অধৈর্য হয়ে উঠছে, যার কোনো গণভিত্তি নেই, যা এখন পর্যন্ত নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করেনি এবং দৃশ্যমান অগ্রগতির অভাব সত্ত্বেও ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে চলছে। এই সরকার বলেছে, ২০২৬ সালের মধ্যভাগে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ একের পর এক খারাপ খবরে বিপর্যস্ত। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি করোনা মহামারির পর সবচেয়ে কম হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও অবনতির দিকে, বাড়ছে সহিংস অপরাধ।গত ২১ মে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সেনা কর্মকর্তাদের বলেন যে, নির্বাচনের সর্বশেষ সময়সীমা ডিসেম্বর হওয়া উচিত। একই দিন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রথমবারের মতো অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপি এর আগেও বহুবার আগাম নির্বাচনের দাবি তুলেছে।
প্রসঙ্গত, মাইকেল কুগলম্যান গত ২১ মে দেওয়া সেনাপ্রধানের বক্তব্য ও একই দিনে বিএনপির আন্দোলনের কথা উল্লেখ করলেও এই একই সময়ে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক আলোচনায় ঘুরেফিরে আসা দুটি প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছেন। এক. মানবিক করিডোর বা চ্যানেল; এবং দুই. বন্দর সম্পর্কিত আলোচনা। এ দুই আলোচনার সূত্রপাত যদিও আরো কিছু আগে। মিয়ানমারের রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে বাংলাদেশ মানবিক সহায়তা করিডোর দেওয়ার বিষয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাব ও তাতে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কিত প্রথম বক্তব্যটি আসে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের তরফ থেকে। এর পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানও এ নিয়ে কথা বলেন, যা রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী মহল, নিরাপত্তা বিশ্লেষক থেকে শুরু করে সচেতন সাধারণ নাগরিকদের অনেকটাই বিভ্রান্ত করে ফেলে। এরই ধারাবাহিকতায় বিদেশি ব্যবস্থাপনায় বন্দর দেওয়ার প্রসঙ্গটি এলে জোর আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপিসহ বাম ধারার দলগুলো এ নিয়ে সুস্পষ্ট শঙ্কা প্রকাশ করে বিবৃতি বক্তৃতা দেয়। এ পর্যায়েই আসে অন্তর্বর্তী সরকারের এ সম্পর্কিত ম্যান্ডেট থাকা না থাকার প্রসঙ্গটি। ফলে নির্বাচনের দাবি জোরালো হয়। এমনই এক পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস পদত্যাগের কথা ভাবছেন বলে বিদেশি সংবাদমাধ্যমে জানান সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ও এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলাম।
কুগলম্যান এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, জুলাই আন্দোলনের শীর্ষ নেতা, শিক্ষার্থী পরিচালিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রধান এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম জানান, যদিও ড. ইউনূস এখনও পদত্যাগ করেননি। তবে, এই হুমকিটি সম্ভবত ইউনুসের একটি কৌশল হতে পারে—পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে তাঁর চারপাশের মানুষদের সতর্ক করার জন্য।
দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক এই বিশ্লেষকের মতে, ইউনূস এখন গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সঙ্গে সংঘাতের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ছাত্রনেতাদের সিদ্ধান্তে সমর্থন দিয়েছেন এবং তাঁদের নীতিগত অবস্থানকেও সমর্থন করেছেন। আর তাঁরা নির্বাচনের সময় পেছালেও সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিএনপি, ব্যবসায়ী মহল এবং সম্ভবত বেশির ভাগ সাধারণ জনগণ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচনের পক্ষে। এই ক্রমবর্ধমান জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন বিভাজনরেখা তৈরি হতে পারে। আগাম নির্বাচনের দাবিতে থাকা বিএনপির সঙ্গে এখন এনসিপি এবং প্রভাবশালী ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামীর মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দলগুলোর সঙ্গে দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে। নানা মতাদর্শী দল যখন নিজেদের দাবি নিয়ে রাজপথে নামে, তখন রাজনৈতিক সহিংসতার আশঙ্কা সত্যিই বেড়ে যায়।
অন্তর্বর্তী সরকার সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনো টানাপোড়েনের কথা অস্বীকার করলেও জেনারেল ওয়াকারের নির্বাচনী আহ্বানকে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ উল্লেখ করে কুগলম্যান লিখেছেন, শেখ হাসিনার অপসারণের পর থেকে সাধারণত রাজনৈতিক বিষয়ে চুপ থাকা ওয়াকারের এমন মন্তব্য জরুরি পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয়। ওয়াকার সরকারের আরও কিছু সিদ্ধান্ত, যেমন ইলন মাস্কের স্টারলিংক পরিষেবা চালুর বিরুদ্ধেও অবস্থান নিয়েছেন।
এ সময়ে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে শত্রুতা আরও বেড়েছে। আওয়ামী লীগের দুর্নীতির দায় শেখ হাসিনা অস্বীকার করায় বাংলাদেশের অনেক মানুষের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে, যা হয়ত অন্তর্বর্তী সরকারের আওয়ামী লীগকে নির্বাচন থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে প্রভাব ফেলেছে। দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব বিদেশে পালিয়ে গেছে। কিন্তু দলের যে অংশ এখনো রয়ে গেছে, তারা এই সিদ্ধান্ত ভালোভাবে নেয়নি।
মাইকেল কুগলম্যানের মতে, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে এই অস্থিতিশীলতা সহিংসতায় রূপ নিতে পারে, যার ফলে মারাত্মক রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হবে। তখন প্রশ্ন উঠবে সেনাবাহিনী নিয়ে–যা এখন আগের চেয়ে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপে অনাগ্রহী। প্রশ্ন উঠেছে, তারা কি নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ না আসা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ নেবে?
এমন জটিল পরিস্থিতির সম্ভাব্য পরিণতি এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে সম্ভাব্য সেরা বিকল্প বিষয়ে কুগলম্যান তাঁর লেখার শেষে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, যদি সবাই শান্ত থাকে, তাহলে এমন পরিস্থিতিতে সেরা সম্ভাব্য পরিস্থিতি হলো–অন্তর্বর্তী সরকার কয়েকটি মূল সংস্কারের বিষয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্মতি নিয়ে এগিয়ে যাবে। সেগুলোর বাস্তবায়নের একটি তারিখ নির্ধারণ করবে এবং নির্বাচনের একটি সময়সূচি ঘোষণা করবে। আশার কথা হলো, রাজনৈতিক দলগুলো ইতোমধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতি একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক রূপান্তরের পথ সুগম করবে এবং ইউনুসের জন্য তাঁর বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিগত জীবনে মসৃণভাবে ফিরে যাওয়ার পথ তৈরি করবে।
এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।